
ফেনীর সোনাগাজীর আলোচিত মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার ছয় বছর আজ বৃহস্পতিবার। ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় চিকিৎসাধীন থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন ওই বছরের আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ আনায় মাদ্রাসা ভবনের ছাদে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় তাঁকে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ১৬ আসামিকে নিম্ন আদালত ফাঁসির দণ্ড প্রদান করলেও উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্স শুনানিতে আটকে আছে কার্যক্রম। এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসামির স্বজনদের হুমকির কারণে অনেকটা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে নুসরাতের পরিবার। এ কারণে দীর্ঘ ছয় বছর ধরে নুসরাতের পরিবারকে থাকতে হচ্ছে পুলিশি পাহারায়।
যেভাবে হত্যা করা হয়
২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল। ফেনীর সোনাগাজীর ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত মাদ্রাসায় গিয়েছিলেন আরবি প্রথম পত্রের পরীক্ষায় অংশ নিতে। পরীক্ষা শুরুর আগে বান্ধবী নিশাতকে মারধর করা হচ্ছে, এমন খবর শুনে ছাদে ছুটে গিয়েছিলেন নুসরাত। সেখানে আগে থেকে অবস্থান নেওয়া পাঁচজন মিলে তাঁকে ছাদে চিত করে শুইয়ে ফেলেন। তাঁর পরনের ওড়নাটি দুই ভাগ করে বেঁধে ফেলেন হাত-পা। এরপর এক লিটার কেরোসিন নুসরাতের গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢালা হয়। ম্যাচের কাঠি দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় পায়ে। আগুন যখন সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, তখন এই পাঁচজন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসেন।
নুসরাত হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীমের (২০) জবানবন্দি থেকে উঠে আসে সেদিনের বিস্তারিত তথ্য। শাহাদাত সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ওই মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী ছিলেন নুসরাত। শরীরের ৮০ শতাংশ পোড়া নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে পাঁচ দিন লড়ার পর ১০ এপ্রিল মারা যান নুসরাত।
কিন্তু কেন এমন কাজ করলেন মাদ্রাসার কিছু শিক্ষার্থী। মৃত্যুর আগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুসরাত ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসকদের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে অধ্যক্ষ সিরাজকে এ ঘটনার জন্য দায়ী করেন। গ্রেপ্তার শাহাদাত হোসেন, নুর উদ্দিনসহ বিভিন্ন আসামির আদালতে দেওয়া জবানবন্দি ও মামলার রায়ে পেছনের কারণ স্পষ্ট হয়। আসামিদের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, নুসরাত খুনিদের লক্ষ্য হন ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ আনার পর থেকেই। ওই ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিন আক্তার সোনাগাজী থানায় মামলা করেছিলেন। এর পর থেকেই মামলা তুলে নেওয়ার জন্য নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল পরিবারটিকে। তবে প্রতিবাদে অনড় ছিলেন নুসরাত। আগুন ধরিয়ে দেওয়ার আগমুহূর্তেও তাঁকে মামলা তুলে নিতে চাপ দেওয়া হয়, কিন্তু নুসরাত তা মানেননি। পরবর্তী সময়ে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায়ও তিনি প্রতিবাদ করে গেছেন
নুসরাত হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার শাহাদাত হোসেন ও নুর উদ্দিন ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম জাকির হোসাইনের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন। ১১ ঘণ্টা ধরে ৫৭ পৃষ্ঠার জবানবন্দিতে তাঁরা ওই দিনের ঘটনার আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন।
এই দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে জড়িত তদন্ত কর্মকর্তারা বলেছেন, গ্রেপ্তার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার সঙ্গে দেখা করতে ৩ এপ্রিল যাঁরা কারাগারে গিয়েছিলেন, অধ্যক্ষ তাঁদের সবার কাছে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। এরপর তিনি আলাদাভাবে মাদ্রাসাছাত্র ও ‘সিরাজ উদদৌলা সাহেবের মুক্তি পরিষদ’ নামে গঠিত কমিটির আহ্বায়ক নুর উদ্দিন (২০), যুগ্ম আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম (২০) এবং আরেক ছাত্রের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেন। তিনি তাঁদের মামলা তুলে নেওয়ার জন্য নুসরাতকে চাপ দিতে বলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি শাহাদাতের সঙ্গে একা কথা বলেন। তখন তিনি চাপে কাজ না হলে প্রয়োজনে নুসরাতকে হত্যার নির্দেশ দেন। আর সে পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যা করা হয় নুসরাতকে।
পুলিশি পাহারায় নুসরাতের পরিবার
সোনাগাজী পৌর শহর থেকে কাশ্মীরি বাজার সড়ক হয়ে উত্তর চর চান্দিয়ায় নুসরাতদের বাড়ি। গতকাল বুধবার সকালে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন এক কনস্টেবল। নুসরাত হত্যার পর সকাল-রাত পালাক্রমে সোনাগাজী মডেল থানার পুলিশের একজন অফিসার, কনস্টেবলসহ একটি দল বাড়ি পাহারায় নিয়োজিত রয়েছে। পুলিশের অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকতেই দোচালা টিনের ঘরের আঙিনায় বসেছিলেন নুসরাতের মা ও ছোট ভাই।
গত বছরের ভয়াবহ বন্যায় অন্য সব বাড়ির মতো নুসরাতের বাড়িও পানিতে ডুবে যায়। সে সময় নুসরাতের অনেক স্মৃতিচিহ্ন নষ্ট হয়ে যায়। নুসরাতের মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে প্রকাশিত সংবাদ–সংবলিত একটি ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে নুসরাতের দগ্ধ ছবি ছিল। সেটি দেখিয়ে তাঁর মা শিরিন আক্তার বলেন, ‘ফুলের মতো মেয়েটি যে কী যন্ত্রণা পেয়েছে, বারবার ভাবি। কখনোই ভুলতে পারি না। যদি হত্যাকারীদের ফাঁসি হয়, তবে কিছুটা সান্ত্বনা মিলবে।
নুসরাতের ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান বলেন, ‘আপুকে (নুসরাত) হত্যার পর থেকে আসামির স্বজনেরা আমাকে শিবির বলে আখ্যা দেয়। আমি নাকি মাদ্রাসায় বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুর করেছি। তারাই আবার ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর আমাকে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের দোসর বলে প্রচার করছে।
মামলার বাদী ও নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক এ ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির স্বজনেরা নুসরাতকে নিয়ে কটূক্তি করে যাচ্ছে। এতে আমরা সব সময় আতঙ্কে থাকছি। যত দ্রুত সম্ভব উচ্চ আদালত মামলাটি নিষ্পত্তি করলে নুসরাতের আত্মা শান্তি পাবে।
পরিবার সূত্র জানায়, নুসরাতের বাবা মাওলানা এ কে এম মুসা জামেয়া সারাফাতিয়া ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষক ও মসজিদের ইমাম। তিনি সপ্তাহে ছয় দিন মাদ্রাসায় থাকলেও বৃহস্পতিবার রাতে বাড়িতে আসেন। শুক্রবার সকালেই আবার কর্মস্থলে ফিরে যান
মামলার রায়ে যা বলা হয়
নুসরাত হত্যার ঘটনায় ঘটনায় তাঁর বড় ভাই মাহমুদুল হাসান সোনাগাজী মডেল থানায় হত্যা মামলা করেছিলেন। আলোচিত এই ঘটনা সারা দেশে তোলপাড় হলে ওই বছরের ২৮ মে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত শেষে মাদ্রাসার অধ্যক্ষসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে ৮৬৯ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করে। ৮৭ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর আদালত রায় ঘোষণা করেন। ১৬ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে উল্লেখ করে প্রত্যেককে মৃত্যুদণ্ড দেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক (তৎকালীন) মামুনুর রশিদ। পাশাপাশি প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ১৬ আসামির ডেথ রেফারেন্সে শুনানি চলছে উচ্চ আদালতে। সাজার পাঁচ বছর পর ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বিচারপতি হাবিবুল গনি ও বিচারপতি জাহেদ মনসুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে ডেথ রেফারেন্সে শুনানি শুরু হয়।
বাদীপক্ষের ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম শাহজাহান সাজু বলেন, বিচারপতিদ্বয়ের গঠিত বেঞ্চে গত পাঁচ মাসে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ১৬ আসামের মধ্যে ৭ আসামির শুনানি শেষ হয়েছে। অপর ৯ আসামির শুনানি শেষ হলে হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ এ মামলার রায় প্রদান করতে পারেন। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ঈদুল আজহার পর এ মামলার চূড়ান্ত রায় হতে পারে। উচ্চ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের মামলা লড়ছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল বাসেত ও আসামিপক্ষে মামলা লড়ছেন ব্যারিস্টার মুশফিকুর রহমান।
দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা কে কোথায়
নুসরাত হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার তৎকালীন অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদদৌলা, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি ও মাদ্রাসার সাবেক সহসভাপতি রুহুল আমিন, সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম, মাদ্রাসার ছাত্র নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন, হাফেজ আবদুল কাদের, আবছার উদ্দিন, আবদুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন, ইমরান হোসেন, মহিউদ্দিন শাকিল, মোহাম্মদ শামীম, কামরুন নাহার ও উম্মে সুলতানা পপি।
ফেনী জেলা কারাগারের জেলসুপার মো. আবদুল জলিল জানান, নুসরাত হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ১৬ আসামির মধ্যে ২ আসামি ফেনী জেলা কারাগারে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতা রুহুল আমিন ও মাকসুদ আলমের বিরুদ্ধে একাধিক মামলার হাজিরা থাকায় তাঁদের ফেনী জেলা কারাগারে রাখা হয়েছে। অপর ১৪ আসামির মধ্যে অনেকে কুমিল্লা জেলা কারাগার, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারসহ বিভিন্ন কারাগারে রয়েছেন।